জনগণের সুখ-দুঃখ জানতে পথেঘাটে ছুটে বেড়ান নলুয়া ইউপি চেয়ারম্যান তছলিমা আকতার।
অকালে স্বামী হারিয়ে হতাশা চারদিক ঘিরে ধরেছিল তছলিমাকে। অবুঝ দুই সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষকতাই ছিল সম্বল। একদিন এলাকার কয়েকজন বয়স্ক নারী সান্ত্বনা দিতে এসে বললেন, ‘তুমি স্বামী হারিয়েছ আর আমরা হারিয়েছি আমাদের বাপ। চেয়ারম্যান পদটা তুমি নিয়ে নাও। আবছারের মতো তুমিও আমাদের দেখাশুনা করতে পারবে।’
নিজস্ব প্রতিনিধি, সাতকানিয়া :::
জনপ্রতিনিধি হওয়ার কথা ছিল না তাঁর। কিন্তু দুর্বৃত্তের হাতে জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়া জনপ্রতিনিধি স্বামীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে তিনিও হয়ে গেলেন জনপ্রতিনিধি। স্বামীর মতো সমান জনপ্রিয়। তিনি হলেন সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের পরপর দুবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান তছলিমা আকতার।
পড়াশোনা শেষে যোগ দেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়। স্বামী নুরুল আবছার ছিলেন উত্তর সাতকানিয়া জাফর আহমদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক এবং নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ জনসেবার নানা দিক চেয়ারম্যান স্বামীর পাশে থেকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তছলিমা।
২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান নুরুল আবছার। সন্ত্রাসীদের বুলেট স্বামীর জীবন কেড়ে নিলেও থেমে যাননি তছলিমা। স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এলাকার উন্নয়ন, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়াসহ মানবসেবায় জড়িয়ে যান তিনি। প্রথম নির্বাচনে সাত প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তছলিমা। সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করে দ্বিতীয়বারে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে পাঁচ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন।
তছলিমা বলেন, ‘এলাকার চেয়ারম্যান হওয়ার বিষয়টি আমার কল্পনায় ছিল না। রাজনীতিতে জড়ানোর ইচ্ছাও ছিল না। স্বামী অধ্যাপনার পাশাপাশি যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বামী চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ও পরে এলাকার উন্নয়ন, মানুষের বিপদে ছুটে চলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং লোকজনের নানা সমস্যার সমাধান দিতে দেখলে আনন্দ লাগত। ’
অকালে স্বামী হারিয়ে হতাশা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল তছলিমাকে। আবছারকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারছিলেন না। অবুঝ দুই সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষকতাটাই ছিল একমাত্র সম্বল। একদিন এলাকার কয়েকজন বয়স্ক নারী তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললেন, ‘তুমি স্বামী হারিয়েছ, আমরা হারিয়েছি আমাদের বাপকে। চেয়ারম্যান পদটা তুমি নিয়ে নাও। আবছারের মতো তুমিও আমাদের দেখাশুনা করতে পারবে। ’ ‘নারীরাও যে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে তা তখন আমার জানা ছিল না। ভাবলাম নলুয়ার উন্নয়ন ঘিরেই ছিল আবছারের স্বপ্ন। আমি চেয়ারম্যান হলে স্বামীর স্বপ্ন আমার হাত দিয়ে বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারব। কিছুটা হলেও ভুলে থাকত পারব স্বামী হারানোর শোক। ’ যোগ করেন তছলিমা।
পরে বিষয়টি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তাঁর ছোটভাই ইমরানের সাথে আলোচনা করেন। ইমরান জানালেন, এটা খুব ভালো হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো নারী চেয়ারম্যান আছেন। তছলিমা বলেন, ‘একটু সাহস পেলাম। কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজন শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না। কারণ ওই সময় চাকরি ছাড়া আমাদের চলার আর কোনো উপায় ছিল না। মা বলল, চেয়ারম্যান হলে আমার স্বামীর মতো আমাকেও মেরে ফেলবে। কিন্তু বাবা আমাকে সাহস যোগালেন। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম জনপ্রতিনিধি হয়ে নলুয়ার উন্নয়ন করে স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। ’
চেয়ারম্যান হওয়ার পর কেমন লাগল জানতে চাইলে তছলিমা বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে চেয়ারম্যান হয়ে আমি কোনো ভুল করিনি। সেদিন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। পাল্টে দিয়েছি এলাকার চিত্র। স্বামীর অসম্পূর্ণ সব কাজ নিজ হাতে সম্পন্ন করেছি। এলাকায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছি। এলাকার উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ, সন্ত্রাস, মাদক ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোসহ নানা কাজের মধ্য দিয়ে স্বামীর স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছি। সব সময় সজাগ থেকে দায়িত্ব পালন করছি। ’
জানা গেছে, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে আগত সেবাপ্রার্থী কোনো মানুষকে হয়রানি হতে হয়নি। এলাকার স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। ইতিমধ্যে অনেক নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদানের পর মেশিনও দিয়েছেন। এখন তাঁরা ঘরে বসে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। এছাড়া বাল্যবিবাহ রোধে বিশেষ সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন তছলিমা। একাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন তিনি।
‘এতে এলাকার কিছু লোকজন আমার ওপর একটু ক্ষুব্ধ হয়েছেন। লোকজনকে বুঝানোর চেষ্টা করছি, নারীদের শিক্ষিত করে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে বিয়ের সময় যৌতুক প্রয়োজন হয় না। নারী শিক্ষার বিষয়ে সরকারের নানা পদক্ষেপ এবং বাল্য বিবাহের বিভিন্ন ক্ষতির দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। বাল্যবিয়ের বিষয়ে কাজিদের কঠোর ভাবে নির্দেশ দিয়েছি। ’ বলেন এই নারী চেয়ারম্যান। তিনি জানান, এলাকায় এখন খুব বেশি কোনো সমস্যা নেই। শঙ্খনদীর ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে মানুষের আশ্রয়ের জন্য দুটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন।
দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমিও অন্যদের মতো সমান বরাদ্দ পাচ্ছি। তবে নারী প্রতিনিধি হিসেবে আমার কাছে মানুষের আবদার একটু বেশি থাকে। গ্রামের অসহায়, দুঃস্থ নারীদের নিয়ে বিশেষ কিছু কাজ করছি। ফলে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা আমাকে আরেকটু বেশি সহযোগিতা করলে এলাকার মানুষ উপকৃত হতেন। ’
‘শুরুর দিকে স্বামীর হত্যাকারীদের ইন্ধনে কেউ কেউ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে এবং বিচারকার্য সম্পাদনে হালকা বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি পিছপা হইনি। খুনিদের বাধার মুখে পিছু হটলে স্বামীর আত্মা কষ্ট পাবে। এ জন্য সবকিছু শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছি। আর আমি সফলও হয়েছে। ’-যোগ করেন তছলিমা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তছলিমা বলেন, ‘দ্বিতীয় মেয়াদে মনোনয়ন যাচাই-বাছাইকারীরা আমার নাম প্রস্তাব না করার পরও তিনি আমাকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। আমিও বিপুল ভোটে জিতে তাঁর আস্থার প্রতিদান দিয়েছি। ’
স্বামীর মৃত্যুর পর দায়িত্ব পালনে দলীয় ভাবে সহযোগিতা না পাওয়ার আক্ষেপ রয়েছে সফল নারী জনপ্রতিনিধি তছলিমার। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ইউপি চেয়ারম্যান ছাড়াও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। সেই হিসেবে স্বামী হত্যার মামলা পরিচালনায় দলীয়ভাবে তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং অর্থের জোগানদাতাদের বাদ দিয়ে মামলার চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। বিভিন্ন স্থানে যেসব দলীয় নেতাকর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবার সরকারি সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু আমি কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা পাইনি। ’
ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন জানিয়ে তছলিমা বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন আমাদের খোঁজ-খবর রাখেন। সন্তানদের পড়ালেখার খরচের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন। ’
মো. জসীম উদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন ও নুরুল কবিরসহ মরফলা এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, চেয়ারম্যান নারী নাকি পুরুষ তা বিবেচ্য বিষয় নয়। একজন চেয়ারম্যানের কাছে মানুষ যেসব সেবার জন্য যায় সেসব সেবা যথাযথভাবে পাচ্ছেন কিনা তা বড় বিষয়। নারী হলেও তছলিমা আকতার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে বিগত কোনো চেয়ারম্যানের সময়ে ততো উন্নয়ন হয়নি। আগে একটি স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানকে কয়েকদিন ধরে খুঁজে বেড়াতে হতো। আর এখন সবাই যেকোনো প্রয়োজনে চেয়ারম্যানকে পাশে পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। আরো বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। আমরা তাঁর কাজকর্মে খুশি।
নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুচ বলেন, ‘চেয়ারম্যান হিসেবে তছলিমা আকতার অত্যন্ত সৎ ও দক্ষ। দায়িত্ব পালনে কোনো গাফিলতি নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্নীতিকে তিনি ছাড় দেন না। পুরোদিন নিজের কাজের চেয়েও এলাকার মানুষের কাজকে বেশি প্রাধান্য দেন। পরিষদের সব সদস্যের সুখে দুঃখেও তিনি পাশে দাঁড়ান। ’
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, ‘তছলিমা আকতার অনেক যোগ্য ব্যক্তি। সরকারের সব নির্দেশনা ও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নারী হিসেবে তিনি বিন্দুমাত্র পিছিয়ে নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ছাড়াও সকল সামাজিক দায়িত্ব তিনি দক্ষতার সাথে পালন করেন। প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করেন। কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের চাইলে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। ’
পাঠকের মতামত: